প্রচারের কারণে জীবপ্রযুক্তি বিষয়টা বর্তমানে আমাদের কাছে খুব পরিচিত। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ শুরু হয় অনেক আগে থেকে। সভ্যতার বিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষ যখন যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ী জীবনযাপন শুরু করে, তখন থেকেই জীবপ্রযুক্তির উৎপত্তি। কারণ, মানুষের কাছে তখনই অধিক ফলনশীল গাছপালা এবং শক্ত-সমর্থ প্রাণিকুল গুরুত্ব পেয়েছে। পছন্দসই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষ তখনই গাছপালা আর প্রাণী বেছে নিতে শুরু করে এবং শুরু হয় জীবপ্রযুক্তির যাত্রা। অনেক আগে থেকে মানুষ অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াকে কাজে লাগিয়ে দই, মদ, বিয়ার, সিরকা, পাউরুটি— এসব উৎপাদন করে এসেছে। এরপর থেকে বিভিন্ন অণুজীবের জৈবিক কর্মকাণ্ডকে কাজে লাগিয়ে শিল্প ক্ষেত্রে এবং মানবকল্যাণে নতুন নতুন উৎপাদন পৃথিবীর জীবপ্রযুক্তির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। জীবপ্রযুক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত গবেষণা জীববিজ্ঞানে নতুন নতুন দিক উন্মোচিত করছে। জীবপ্রযুক্তিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন মানবকল্যাণে প্রয়োগের জন্য জীবকে ব্যবহার করে বিভিন্ন উপাদান তৈরির প্রযুক্তিকে জীবপ্রযুক্তি বলা হয়। আমেরিকার National Science Foundation- এর দেওয়া সংজ্ঞানুযায়ী জীবপ্রযুক্তি বলতে বুঝায় মানকল্যাণের উদ্দেশ্যে জীব প্রতিনিধিদের (যেমন: অণুজীব বা জীবকোষের) কোষীয় উৎপাদনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। যদিও দই, সিরকা, পাউরুটি, মদ, পনির ইত্যাদি উৎপাদন জীবপ্রযুক্তির ফসল কিন্তু এসব জীবপ্রযুক্তিকে পুরোনো জীবপ্রযুক্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়। সম্প্রতি আণবিক জীববিজ্ঞানের গবেষণার মাধ্যমে জীবপ্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে, তাকে বলা হয় নতুন বা আধুনিক জীব প্রযুক্তি। বাস্তবিক অর্থে আধুনিক জীবপ্রযুক্তি তিনটি বিষয়ের সমন্বয়। যথা:
১. অণুজীব বিজ্ঞান
২. টিস্যু কালচার
৩. জিন প্রকৌশল
তাই জীবপ্রযুক্তি হচ্ছে একটি সমন্বিত বিজ্ঞান। বর্ণিত তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীববিজ্ঞানের অত্যধুনিক এই শাখাটি মানবসভ্যতার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
১১.২.১ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
বংশানুগতির উপাদানের প্রকৃতি, রাসায়নিক গঠন এবং জৈবনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিসমূহ আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা আর একটা বিষয় নিয়ে ভাবা শুরু করলেন। তাঁরা দেখলেন, একটা জীবের সকল জিনই তার জন্য মঙ্গলজনক নয়। এ ভাবনার ফলে জন্ম নিলো জিন প্রকৌশল নামে জীববিজ্ঞানের এক নতুন শাখা। একটি জীব থেকে একটি নির্দিষ্ট জিন বহনকারী ডিএনএ খণ্ড পৃথক করে ভিন্ন একটি জীবে স্থানান্তরের কৌশলকে জিন প্রকৌশল (Genetic Engineering) বলে। আরও সহজভাবে বলতে পারি কাঙ্ক্ষিত নতুন একটি বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির জন্য কোনো জীবের ডিএনএ-র পরিবর্তন ঘটানোকে জিন প্রকৌশল বলে। এই জিন যে কৌশলগুলোর মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়, তাদের একত্রে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ কৌশল বলে। রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ কৌশল অবলম্বন করে একটি ডিএনএ অণুর কাঙ্ক্ষিত অংশ কেটে আলাদা করে অন্য একটি ডিএনএ অণুতে প্রতিস্থাপনের ফলে যে নতুন ডিএনএ অণুর সৃষ্টি হয়, তাকে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ বলে। রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ তৈরির প্রক্রিয়াকে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তি বা জিন ক্লোনিং বলা হয়। মানুষের অন্ত্রে বসবাস করে একধরনের ব্যাকটেরিয়া যার নাম Escherichia coli। এই ব্যাকটেরিয়ার ওপর গবেষণা করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধিকাংশ কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তি নিচে উল্লেখ করা ধাপগুলো (চিত্র ১১.০৮) অবলম্বন করে সম্পন্ন করা হয়:
১. প্রথমে দাতা জীব থেকে কাঙ্ক্ষিত জিনসহ ডিএনএ অণুকে পৃথক করা হয়। এরপর এই জিনের বাহক বা ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিড ডিএনএ পৃথক করা হয়।
E. coli
দুটি উৎস E. coli ও প্রাণিকোষ) থেকে DNA-র পৃথকীভবন
প্রাণিকোষ
রেস্ট্রিকশন এনজাইমের সাহায্যে উঠা DNA-কে খণ্ডিত করণ
গাঁথন প্রান্ত
কাঙ্খিত জিন
রিকম্বিনেট DNA প্লাজমিড
DNA লাইগেজের সহায়তায় উভয় © DNA-র সংযোজন এবং রিকম্বিনেট DNA সৃষ্টি
কাঙ্খিত জিন
ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় রিকম্বিনেট DNA প্লাজমিড-এর ব্যাকেটেরিয়ামে প্রবেশ
ব্যাকেটেরিয়ামের ক্লোনিং:
চিত্র ১১.০৮: কাঙ্খিত জিন বহনকারী ব্যাকটেরিয়া ক্লোন
প্লাজমিড হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া কোষের ক্রোমোজোমের বাইরে আরেকটি স্বতন্ত্র ডিএনএ অণু যেটি বিভাজিত হতে পারে বা শবিভাজনে সক্ষম।
২. এ ধাপে প্লাজমিড ডিএনএ এবং দাতা ডিএনএ এক বিশেষ ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক দিয়ে খণ্ডিত করা হয়। দাতা ডিএনএর এসব খন্ডের কোনো একটিতে কাঙ্ক্ষিত জিনটি থাকে।
৩. এ ধাপে লাইগেজ নামক একধরনের এনজাইম দিয়ে দাতা ডিএনএ কে প্লাজমিড ডিএনএ এর কাটা প্রান্ত দুটোর মাঝখানে স্থাপন করা হয়। লাইগেজ এখানে আঠার মতো কাজ করে। এর ফলে নির্দিষ্ট জিনসহ রিকম্বিনেন্ট ডিএএন প্লাজমিড তৈরি হয়। এই রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিড এখন দাতা ডিএনএ র খণ্ডিত অংশ বহন করে।
৪. এখন এই রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিডকে ব্যাকটেরিয়ার ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। খণ্ডিত ডিএনএ গ্রাহক কোষে প্রবেশ করনোর পদ্ধতিকে ট্রান্সফরমেশন বলে। ট্রান্সফরমেশনের ফলে নতুন জিন নিয়ে যে ব্যাকটেরিয়া বা জীবের উদ্ভব ঘটে, তাকে ট্রান্সজেনিক জীব বলে।
৫. এরপর নির্দিষ্ট জিন বহনকারী রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিড ধারণ করা ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করে আলাদা করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট জিন বহনকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ঘটানো হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোর প্রত্যেকটিতে এখন একটি করে কাঙ্ক্ষিত জিন রয়েছে। এই পদ্ধতিতে জিন তৈরি করাকে বলা হয় জিন ক্লোনিং। জিনকে ব্যবহার করার জন্য প্লাজমিডকে আবার আলাদা করে নেওয়া হয়।
১১.২.২ ক্লোনিং
প্রাকৃতিক ক্লোন বলতে একটি জীব অথবা এক দল জীবকে বোঝানো হয়, যাদের উদ্ভব ঘটে অযৌন অঙ্গজ প্রজননের দ্বারা। এগুলোর প্রকৃতি হয় পুরোপুরি তার মাতৃজীবের মতো। জীব ছাড়াও একটি কোষ বা একগুচ্ছ কোষ যখন একটিমাত্র কোষ থেকে উৎপত্তি হয় এবং সেগুলোর প্রকৃতি মাতৃকোষের মতো হয়, তখন তাকেও ক্লোন বলে। প্রকৃতিতে ব্যাকটেরিয়া, অনেক শৈবাল, বেশির ভাগ প্রোটোজোয়া এবং ইস্ট ছত্রাক ক্লোনিং পদ্ধতি দিয়ে বংশবৃদ্ধি করে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তিন ধরনের ক্লোনিং করা হয়।
১. জিন ক্লোনিং: একই জিনের অসংখ্য নকল তৈরি করাকে জিন ক্লোনিং বলে। জিন ক্লোনিং রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ টেকনোলজির সাহায্যে ঘটানো হয়।
২. সেল ক্লোনিং: একই কোষের অসংখ্য হুবহু একই রকমের কোষ সৃষ্টি করাকে সেল ক্লোনিং বলে।
৩. জীব ক্লোনিং: দুটির পরিবর্তে একটিমাত্র জীব থেকে জিনগত হুবহু এক বা একাধিক জীব তৈরির পদ্ধতিকে জীব ক্লোনিং বলে।
ডলি নামক ভেড়া হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী, যা একটি পূর্ণবয়স্ক দেহকোষ থেকে ক্লোন করা হয়েছে। ক্লোন করার সময় নিচের ধাপগুলো (চিত্র ১১.০৯) অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে ডিম্বাণু থেকে যে প্রাণী সৃষ্টি হয়, তা হুবুহ তার মাতার মতো হয়।
অনিষিক্ত ডিম
দাতা ভেড়া
নিউক্লিয়াস অপসারণ
নিউক্লিয়াসযুক্ত কোষের স্থানান্তর
কোষ কালচার
এবং জীনগত পরিবর্তন
পালক মায়ের শরীরে ভ্রুণ স্থানান্তর
দাতা ভেড়ার অনুরূপ জিনসহ মেষশাবক
চিত্র ১১.০৯: ডলির সৃষ্টি
১. ডলি নামক ভেড়াকে ক্লোন করার জন্য বিজ্ঞানীরা একটা ছয় বছর বয়সের সাদা ভেড়ার দুধগ্রন্থি থেকে কোষ সংগ্রহ করেছেন।
২. এই কোষের ভেতরের নিউক্লিয়াসটিকে তার কোষে “অভুক্ত” রাখা হয়েছে, যেন এটি যে দুগ্ধগ্রন্থির একটি কোষের নিউক্লিয়াস এই তথ্যটি ভুলে যায়।
৩. কালো মুখের আরেকটি ভেড়া থেকে একটি ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তার ভেতরকার নিউক্লিয়াসটিকে অপসারণ করা হয়েছে।
৪. সাদা ভেড়া থেকে সংগ্রহ করা কোষের নিউক্লিয়াসটি এবার ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এবং ইলেকট্রিক শক দিয়ে নিউক্লিয়াসটিকে কার্যকর করা হয়েছে।
৫. ডিম্বাণুটি ভ্রূণে পরিণত হওয়ার পর সেটি একটা পালক মাতা ভেড়ার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মাতা ভ্রুনটিকে যথাসময়ে মেষশাবক হিসেবে জন্ম দিয়েছে। এই মেষশাবকটি হুবহু তার মায়ের মত।
এই ক্লোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লোন ইঁদুর, খরগোস, গরু ও শুকর এমনকি বানর পর্যন্ত ক্লোন করা হয়েছে। ইঁদুর, ভেড়া, বানর প্রভৃতি ক্লোনিংয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি এখন মানুষের ওপর। এ প্রক্রিয়াটি এখন আর দুরূহ নয়, কিন্তু ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ মানুষের ক্লোন করার প্রক্রিয়া আইন করে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। ক্লোনিংয়ের সামাজিক প্রভাব: সম্পূর্ণ প্রাণীর ক্লোনিংকে বলে রিপ্রোডাকটিভ ক্লোনিং। 'ডলি' নামক ভেড়া তার উদাহরণ। পশুদের ক্লোনিং নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি, তবে এর মধ্যে মানুষের ক্লোনিংয়ের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। এখন এর নৈতিকতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
নৈতিকতা প্রশ্নগুলো এরকম:
প্রথমত হচ্ছে ক্লোনিং হয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুটি যখন বড় হবে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব ওই ক্লোন হতে পাওয়া ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের মতো হবে, নাকি অন্যরকম হবে। দ্বিতীয় এইভাবে ক্লোন হয়ে সৃষ্টি হওয়ায় শিশুটির উপর কী কোনো ধরনের সামাজিক চাপ থাকবে? ক্লোনিং জাত শিশুটি সম্পূর্ণ সুস্থ হবে, নাকি প্রতিবন্ধী বা বিকলাঙ্গ হবে, সেটি সম্পর্কেও বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন। এখন পর্যন্ত মানুষ বা মানবগোষ্ঠীর সফল ক্লোনিংয়ের খবর পাওয়া যায়নি। আরব্য উপন্যাসের সেই দৈত্যের কাহিনী আমরা জানি, যাকে বোতল থেকে বের করার পর পুনরায় বোতলে ঢোকানো যায়নি। পরমাণু শক্তির মতো জীবপ্রযুক্তি ঠিক তেমন এক অবাধ্য শক্তি। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে, দায়িত্বশীল মানুষের মতো বিবেচনা করে মানবজাতির কল্যাণে এই জীবপ্রযুক্তিকে কাজে লাগানো।
Read more